বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০৭:২১ অপরাহ্ন

পুলিশ ম্যানেজড ভাঙো বাড়ি বানাও ভবন

পুলিশ ম্যানেজড ভাঙো বাড়ি বানাও ভবন

স্বদেশ ডেস্ক:

২০১০ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের একটি বাড়ির প্রতি চোখ পড়ে ভূমিদস্যু দুই ভাই আবেদ ও জাবেদের। তারা ভাবলেন, বাড়িটি অবৈধভাবে দখলে নিতে প্রথমে প্রয়োজন স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করা। যেই ভাবনা, সেই কাজ। মোটা টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করা হলো পুলিশকে। এর পর ম্যানেজড পুলিশই এগিয়ে এলো রাজধানীর বংশালের ওই বাড়িটি দখলে। অতঃপর দখল হয়ে গেল খুব সহজেই। এর পর দখলকৃত জমির পুরনো তিনতলা বাড়ি ভেঙে শুরু হলো নতুন ভবন নির্মাণ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি ম্যানেজড সেই পুলিশ কর্তার। টাকার বিনিময়ে বাড়ি দখলে সহায়তা করার অপরাধে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান। গত রবিবার রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে এ বিষয়ে জারি করা হয় প্রজ্ঞাপন। একই কা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে বংশাল থানার

তৎকালীন ওসি বর্তমানে কোতোয়ালি থানায় কর্মরত শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। যদিও তিনি কোতোয়ালি থানায় ওসি হিসেবে এখনো বহাল আছেন।
অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর বংশাল থানার ২২১ নবাবপুর রোডের বাড়িটি দখলে সহায়তার জন্য পুলিশের ডিসি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান ২ কোটি টাকা ঘুষ নেন; ওসি শাহিদুর রহমান নেন ১ কোটি টাকা। এর পর বাড়িটি দখলে নিতে সব ধরনের সহায়তা করেন ডিসি-ওসি ও এসআই জাহাঙ্গীর হোসেন। এক রকম পুলিশ পাহারাতেই বাড়িটি দখল হয়।
প্রসঙ্গত, একাত্তরে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক শামসুল হক খানকে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে হত্যা করা হয়। এর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে শামসুল হক খানের মা মাসুদা খানমকে ২২১ নবাবপুর রোডের চার কাঠা প্লটটি ইজারা দেন। তার মৃত্যুর পর উত্তরসূরি হিসেবে দুই ছেলে ফজলুল হক খান ও আজহারুল হক খান ওই জমি বরাদ্দ পান। পরিবারের পক্ষ থেকে ওই জমিতে মাসুদা করপোরেশন ও এসএইচকে করপোরেশন নামে দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
শামসুল হক খানের নাতি শামসুল হাসান খান আমাদের সময়কে জানান, গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় ভূমিদস্যু আবেদ-জাবেদ তাদের বাড়িতে হামলা চালান। তারা সেখানে থাকা প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের মেশিনারিজও লুটপাট করে নিয়ে যান। এ সময় ওই বাড়ির কেয়ারটেকার ও শামসুল হাসান খানের পরিবারকে মারধর করে বেঁধে রাখা হয়। পরদিন প্রায় ২শ শ্রমিক নিয়ে বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করেন দখলদাররা। খান জানান, বাড়ি ভাঙার বিষয়টি নিয়ে থানাপুলিশ ও লালবাগের তৎকালীন পুলিশের ডিসি ইব্রাহিম খানের কাছে গেলে তারা নানা টালবাহানা শুরু করেন। উপরন্তু পুলিশি সহায়তায় নতুন করে বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু করেন জাবেদ ও আবেদ। নিরুপায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত জানালে তিনি ডিএমপি কমিশনারকে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। এর পর ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া অধীনস্থ যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলমের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জবানবন্দি গ্রহণ এবং দালিলিক তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পরে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন দাখিল করা হয় ডিএমপি কমিশনারের কাছে। পুলিশ কমিশনার প্রতিবেদন পাঠান সদর দপ্তরে। পরে পুলিশের আইজি এ ব্যাপারে ডিসির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ পাঠান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণকৃত প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রবিবার রাতে ডিসি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খানকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাকে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয় ওই আদেশে।
পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অপরাধের সংবাদ পেয়ে ওসি, এসআই জাহাঙ্গীর আলম ও এসআই মাহবুবের বিরুদ্ধে বাড়ি দখলে জড়িত থাকার ঘটনার সত্যতা পান। কিন্তু মামলাটি আমলযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন, লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার এবং ভিকটিমের জানমালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি পুলিশ। পক্ষপাতদুষ্ট আচরণে জনমনে পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিয়েছে। সার্বিক অনুসন্ধানে এবং প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ককে অবৈধভাবে আটক করে ডাকাতি বা সম্পদ লুণ্ঠনসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে প্রচলিত আইনে মামলা রুজুর নির্দেশ না দিয়ে এবং বিল্ডিং ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও ব্যবস্থা গ্রহণ না করে অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন ও চরম গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিষয়টি ফৌজদারি অপরাধে পরোক্ষ সহায়তার শামিল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ডিসি লালবাগ মোহাম্মদ ইব্রাহিম খানের তদন্ত তদারকি প্রতিবেদন এবং টুর ডায়েরি পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয় তিনি তড়িঘড়ি করে দায় এড়ানোর জন্যই তদন্ত তদারকি প্রতিবেদন দিয়েছেন। ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ে অবস্থিত তিনতলা ভবনটি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে সেখানে নতুন করে ভবন তৈরির নিমিত্তে বেজমেন্ট করাসহ নির্মাণকাজ চলমান থাকার বিষয়ে তাকে মৌখিকভাবে অবহিত করা হলেও তিনি (ডিসি) যথাযথ পদক্ষেপ নেননি। এ ছাড়া ঘটনার বিষয়ে প্রচলিত আইন পর্যালোচনাসাপেক্ষে মামলা রুজুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত ছিল। সে ক্ষেত্রে কারও ব্যক্তিগত বা বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত মতামত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আরও উল্লেখ থাকে যে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ কমিশনারের মৌখিক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার সুষ্ঠু অনুসন্ধানের নিমিত্তে গঠিত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করে নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হলে তার (ডিসি) ওপর তলব করা ব্যাখ্যার জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় কমিশনার কর্তৃক ‘অসন্তোষ জ্ঞাপন’ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সম্পত্তিতে অনুপ্রবেশ করে অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ককে আটকে রেখে ডাকাতি বা সম্পদ লুণ্ঠনসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে প্রচলিত আইনের উপর্যুক্ত ধারায় মামলা রুজুর বিষয়ে তদারকি কর্মকর্তা হিসেবে সঠিক নির্দেশনা দেননি। এ ছাড়া সেখানে অবস্থিত ৩ তলা ভবন সম্পূর্ণরূপে ভেঙে অবৈধভাবে দখলসহ পরবর্তী সময়ে নতুনভাবে নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখার বিষয়ে ডিসি লালবাগ মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও চরম গাফিলতির প্রমাণপত্র কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয়েছে।
এর আগে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল থেকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত মাসোহারা নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরা হয় ডিসি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খানের বিরুদ্ধে। তখন বিষয়টি ধামাচাপা দিতে নানামুখী তৎপরতা চালান তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করেও ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইব্রাহিম খানকে পাওয়া যায়নি। অভিযুক্ত আরেক কর্মকর্তা বংশাল থানার তৎকালীন ওসি (বর্তমানে ওসি কোতোয়ালি) শাহিদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে আমি কোনো টাকা নিইনি।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877